বই রিভিউ
অন্তরীণ-পর্বের কবিতা
তৈমুর খান
জীবনের দাবি থেকে, বাঁচার দাবি থেকে, স্বপ্নের দাবি থেকে আমরা সারা জীবন রাস্তার অন্বেষণ করে গেছি। এই রাস্তাই তো মানবসভ্যতার রাস্তা। এই রাস্তাই তো ক্লান্তিহীন জন্ম-জন্মান্তরের রাস্তা। সেই রাস্তারই অন্বেষণ পেলাম কবি তপন গোস্বামীর 'অন্তরীণ-পর্ব' (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২১) কাব্যগ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থটি খুলেই 'রাস্তা' কবিতাটি চোখে পড়ল আর ওই একটা কবিতাই আমাকে উথাল-পাথাল করে দিল। যে জীবন দর্শনের ভেতর আমাদের চিরন্তন অভিমুখ সেই সচলতাকেই ধারণ করে আমরা এগিয়ে চলেছি। এই এগিয়ে চলার কোথাও থামা নেই। এভাবেই কবিতাটি শুরু হয়েছে:
"মাথার ওপরে চন্দ্রাতপ নেই
ঘুমচোখে এতখানি পথ, সমস্ত জীবন
ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো ঝুলে আছে ভরসন্ধেবেলা।
হাঁটছি তো হাঁটছিই, হাঁটছি তো হাঁটছিই
পেরিয়ে যাচ্ছি মহাকাশ,মাঠভরা নক্ষত্রের বন
তোমাদের দরজা জানলা ফসল বন্দর
গির্জার ঘন্টাধ্বনি, যাত্রাপালা, রাবেয়া রাবেয়া…
কোথাও সিগন্যাল নেই, নীল লাল আলো নেই
কোন ফরিস্তার হাতে আজ আর আমাদের আয়ুরেখা নেই।"
অন্তরীণ-পর্ব অর্থাৎ করোনাকালীন আবহে যে লকডাউন শুরু হয়েছে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অনাহার-অর্ধাহারে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টা দেখা দিয়েছে; সেখানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু সে বিষয়ে সংশয় আছে। 'হাঁটছি তো হাঁটছিই' চলমান ক্রিয়াপদটি মহাকাশ, নক্ষত্র, গির্জা, যাত্রাপালার মঞ্চ সব পেরিয়ে যাচ্ছে। কোথাও বিশ্রামের অবকাশ নেই। সম্মোহনের আকর্ষণ নেই। শুধু আপনজনকে অন্তিমডাকের করুণ কণ্ঠস্বর আছে 'রাবেয়া রাবেয়া'। আয়ুরেখা শেষ হয়ে আসা জীবনের এই পর্বই অন্তরীণ-পর্ব।
কবিতার দ্বিতীয় অংশে ভাতের স্বপ্নই আরো মারাত্মক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য ভাত বেড়ে বসে থাকে না। অন্নদামঙ্গলের অন্নপূর্ণাও গরমভাত কারো শিয়রে রেখে যায় না। শুধু ভাতের লড়াই করে কোনো জেলখাটা কবি দৈন্যের কথা লিখে যান। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই যেমন মরে যেতে হয়। তেমনি স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আবার জীবিত হয়ে উঠতে হয়। এই স্বপ্ন দেখা, এই বাঁচা-মরা, এই পথ অতিক্রম করা কখনও শেষ হয় না। এই কবিতার শেষ অংশে সেই দার্শনিক উচ্চারণটি আমাদের মর্মকে বিদ্ধ করে:
"রাস্তা কিন্তু তখনও শেষ হয় না
চাপচাপ রক্তের কথা সে ভুলে যায়
ধুলোমাখা স্বপ্নের কথা ভুলে যায়
কেবল পায়ের চিহ্নগুলো থেকে যায় আদিঅন্তকাল।"
দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ করতে করতেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যে রক্তক্ষরণ, যে মৃত্যু ও হা-হুতাশের পাশ কাটিয়ে আমরা যাই, আমাদের পূর্ণতাকে খুঁজে পাবার জন্য—তা কিন্তু চিরদিনই অধরা থেকে যায়। শুধু আমাদের কষ্টের, শুধু আমাদের আত্মোৎসর্গের, শুধু আমাদের ক্ষয়ের পদচিহ্নগুলি থেকে যায় সভ্যতার রাস্তায়। সমসাময়িক তুর্কি নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং চিন্তাবিদ মেহমেত মুরাত ইলদান (১৯৬৫) লিখেছেন: "In the streets where poverty and misery prevail, there is everything but the street, huge stones, big pits, deep holes and so on!"
অর্থাৎ যে রাস্তায় দারিদ্র্য ও দুর্দশা বিরাজ করছে, সেখানে রাস্তা, বিশাল পাথর, বড় বড় গর্ত, গভীর গর্ত ইত্যাদি ছাড়া সবই আছে!
এই সেই রাস্তা যে রাস্তা আমাদের সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, মৃত্যু ও অনাহারকে চিহ্নিত করে রেখেছে।
লকডাউনে গৃহবন্দি জীবন যেমন এনে দিয়েছে, তেমনি গৃহহারা পথের জীবনকেও চিনিয়ে দিয়েছ। আমরা নিজের দিকে তাকিয়েছি, আবার অন্যের দিকেও চেয়ে দেখেছি। তাই কবি একবার বলেন:
"লকডাউন, তুমি না দেখালে
আমার সঙ্গে আমার দেখাই হতো না।"
অনেক ছোটখাটো এড়িয়ে যাওয়া কাজগুলোও কবি মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ করেছেন। রান্নাঘর থেকে ঘর-গেরস্থালি, দুপুরের রোদ থেকে উঠোনের গাছপালা এবং প্রতিদিনের পাখি, মায়ের ফটোর দিকে তাকানো, চড়ুইয়ের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া, ফাঁকা বাজারে ঠেলাওয়ালার সঙ্গে পরিচয়—কতকিছুর অবসর এনে দিয়েছে। আবার গৃহবন্দি জীবনের একঘেয়েমি ঝগড়াঝাঁটি দাম্পত্য কলহ কবি আঁচ করেছেন। রেললাইনে কাটাপড়া শ্রমিক, ছিটকে পড়ে থাকা তাদের রুটির দৃশ্য বিপন্ন করে তুলেছে। মৃতের শহরে নিজেকেই পরীক্ষা করেছেন নিঃশ্বাস পড়ে কিনা। অর্থাৎ নিজেকেও মৃতদেহ মনে হয়েছে। কোথাও যাওয়ার নেই। মৃতদেহের সৎকার করার কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখা নেই। নিষিদ্ধ নগরীতে নির্বাসিত জীবন। রিলিপের ক্যাম্প গজিয়ে উঠেছে। মনুষ্যেতর জীবনের পরিচয় চারিদিকে। মাস্ক লাগিয়ে মুখ ঢেকে আত্মগোপনের এক চক্রান্ত। হাসপাতালে ভিড়। অক্সিজেনের অভাব। ভোরের গায়ে স্বপ্নের গন্ধ খুঁজেছেন কবি। ছন্নছাড়া এক যাপনের ক্রিয়ায় সম্পর্ক, প্রেম, মানবিকতা সব দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পৌরাণিক মিথের মধ্যেও সেই প্রেমের জাগরণ আর দেখতে পাননি। তাই লিখেছেন:
"রাধা কিংবা ষোড়শ গোপিনী
আজ কেউ নিরাপদ নয়
একদিকে চতুর কানাই
অন্যদিকে ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে ক্ষয়।"
প্রেমঘাতী কানাই যে প্রেমিক নয়, প্রেমিকের ছদ্মবেশ মাত্র—এই মুহূর্তে দেখা গেছে। তেমনি শিল্পী রামকিঙ্করের বিমূর্তকলা কলাভবনের মাঠে ঘনঘোর বর্ষায় বাস্তুহারার মতো অকালে দিশেহারা।
সব মিলিয়েই ছোট-বড় মোট ৫৫ টি কবিতা নিয়ে এটি একটি রুদ্ধশ্বাস সময়ের কাব্য যা প্রতিমুহূর্তে জীবনকে সংশয়ে দোলায়িত করেছে। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ফিরে আসেনি। অন্তরীণ-পর্ব যেমন বাঁচার লড়াই করতে শিখিয়েছে, তেমনি দাগাবাজ ধান্দাবাজ ভণ্ড নেতাদের চিনিয়েও দিয়েছ। মিশ্রবৃত্ত ছন্দে কবিতার বুনন, কখনও নিছক গদ্যেও সময়কে ধারণ করেছেন কবি। সে দিক দিয়ে কাব্যটি একটি ইতিহাসের, একটি সময়ের অমোঘ উচ্চারণ বলা যেতে পারে।
অন্তরীণ-পর্ব: তপন গোস্বামী, আশাদীপ প্রকাশনী,১০/২ বি রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯, প্রচ্ছদ:মৃণাল শীল, মূল্য ১২৫ টাকা।
Post a Comment