কবিতার রূপকল্প : || স্বাধীনোত্তর বাংলা কবিতা ।| সৌম্য ঘোষ
মধ্য রাত্রির পর যারা জন্মেছেন অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর । এই নতুন প্রজন্মের কবিদের কয়েকজন সংগঠিত করেছিলেন উত্তরাধুনিকতার আন্দোলন । এই কবিদের মধ্যে প্রধান অমিতাভ গুপ্ত (১৯৪৭), অঞ্জন সেন (১৯৫১) ইত্যাদি। আধুনিকবাদী অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বাংলা কবিতায় তাঁরা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন মধ্যযুগ থেকে চলে আসা আবহমান দেশজ কাব্যের ধারাকে। তাঁদের লক্ষ্য , আবহমান দেশজ কাব্যের ধারা এবং দেশীয় ঐতিহ্য আত্মস্থ হওয়া।
স্বাধীনতার কালের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে আছেন ভাস্কর চক্রবর্তী , রনজিত দাশ (১৯৫০), সব্যসাচী দেব (১৯৪৬) , জয় গোস্বামী (১৯৫৪) । বর্তমান সময়ের আর্তি , নিরালম্ব শূন্যতা, নিদ্রাহীনতা ঘুরে ফিরে এসেছে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় :
কবি সব্যসাচী দেবের বিখ্যাত কবিতা "কর্ণ " থেকে কিছু স্তবক :
"আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক।"
বাংলা ভাষার উত্তর জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসাবে পরিগণিত। তাঁর কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ। তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। "বজ্র বিদ্যুৎ ভর্ত্তি খাতা" কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবাংলার আকাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর কবিতার একটি বিখ্যাত পংক্তি:
‘‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে / হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে'’’।
মোটামুটি ভাবে বলা যায়, পঞ্চাশ দশক থেকেই বাংলা কবিতার নব্য আধুনিকতার সূত্রপাত । তখন থেকেই শুরু হয়েছিল স্বাবলম্বী বাংলা কবিতার যাত্রা । সেই যাত্রা, দেশে যে ঐতিহ্যকে স্বীকার করে, পশ্চিমী আদর্শের বালাই না রেখে, পুরোপুরি শুরু হয় সত্তর দশক থেকে । এই কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্র অনুসারী , রবীন্দ্র প্রভাবিত, রবীন্দ্র পরবর্তী, জীবনানন্দ প্রভাবিত, আধুনিক বা অতি আধুনিক বা আন্দোলনমুখী -------- এমন কোন বিশেষণ নেই এনাদের ক্ষেত্রে।
এনারা একেবারেই আত্মনির্ভর এবং স্বচ্ছ ভাবধারার । এখন যা লেখা হচ্ছে, কলকাতা বা মফঃস্বলের, ছোট-বড় সব পত্রিকায় , তা একেবারেই বাংলা কবিতা । এইসব কবির কবিতায় দেশজ জীবন , মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতার উপলব্ধি , বেদনার বার্তা , নৈসর্গিক চরাচর, সংবেদনশীল পদাবলীতে স্থায়িত্ব পায়।
আর্থিক দিক দিয়ে উন্নত, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলিতে কবিতার মৃত্যুর পরোয়ানা অনেক আগেই জারি হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও পণ্য সভ্যতা মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে ভোগ, আরো ভোগের মসৃণ রেশমি সুখের অভিমুখে । এখন সঞ্চার ইন্টারনেটে , ই-মেলে , ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে । বাংলা কবিতা তো বটেই, বাংলা ভাষাও এখন আক্রান্ত । তবুও এই দেশ, গরিব অনগ্রসর দেশ বলেই হয়তো, এখনো কবিতা বেঁচে আছে । এখনো আমরা মুগ্ধ কবিতা পাই , যাদের কবিতা থেকে ---------
মৃদুল দাশগুপ্ত, সুবোধ সরকার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় , অনুরাধা মহাপাত্র, অঞ্জলি দাশ , জয়দেব বসু, সুতপা সেনগুপ্ত, রুপা দাশগুপ্ত , মল্লিকা সেনগুপ্ত , জহর সেন মজুমদার এবং আরো আরো আরো অনেকে কাছ থেকে ।
এমন কিছু কবিতার স্তবক আপনাদের কাছে রাখছি :::
এই দীর্ঘ প্রবন্ধ "কবিতার রূপকল্প"
শেষ অংশে এসে, দাবি করতে পারি, বাংলা ভাষায় লেখা হচ্ছে পৃথিবীর আসল কিছু কবিতা। হাজার বছর আগে মেঘে , মেদুর আকাশের নিচে , খরস্রোতা নদীর তীরে, রাজসভায় বা পর্ণকুটিরে, শষ্য সবুজ বাংলার মাটিতে , শুরু হয়েছিল বাংলা কবিতার উচ্চারণ , সেই উচ্চারণ আজও শত শত কন্ঠে মুখর । কবিতা লেখা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্ৰামে- গঞ্জে , ঢাকা, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে-প্রান্তরে , কলকাতায় , কলকাতার বাইরে মফস্বল বাংলায় , পুরুলিয়া, হলদিয়া , জঙ্গিপুর, কাকদ্বীপ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ,মেদিনীপুর ,দিনাজপুর, বাঁকুড়া । কোথায় না ?
বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে মান্য করে হাজার বছরের পুরনো বাংলা কবিতা নিত্য নবীনতা দীপ্ত ও উজ্জ্বল ।।
এই প্রবন্ধের বিষয়ে আমার কোন মৌলিকতার দাবি নেই। এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমি দীনেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের বহু ঐতিহাসিকদের শরণাপন্ন হয়েছি । বিভিন্ন বই- পত্রপত্রিকা, গুগুল ,
উইকিপিডিয়া , আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে প্রয়োজন মত ব্যবহার করেছি । কখনো নিজের পুরোনো লেখাও ব্যবহার করেছি । যেহেতু এই প্রবন্ধটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্র নয় , বিশেষজ্ঞদের জন্য নয় ; কবিতা অনুরাগী সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা , তাই উৎস নির্দেশের প্রয়োজন বোধ করিনি ।
_______ অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া। হুগলী ।
Post a Comment