বিপর্যয় - কলমে – ছন্নছাড়া

 

https://sahityapuran.banglamancha.com/


শরদিন্দুবাবু মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সন্তান। দেশভাগের পর তাঁর বাবা যখন ভাগ্যের সন্ধানে বাংলাদেশের সমস্ত বিষয় সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে একবস্ত্রে ভারতে চলে আসেন, তাকেও চলে আসতে হয় বাধ্য হয়েই। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর বাবার মৃত্যু হল। মাকে নিয়ে যা হোক করে জীবনযাপন চলতে লাগল।

তারপর বহুকষ্টে লেখাপড়ার জীবন শেষ করে ট্রাম কোম্পানিতে একটি ভালো পদে চাকরি পান। কিন্তু তার পরপরই মাকেও হারান তিনি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিবাহ করে সংসার পাতেন কলকাতার বুকে এক ভাড়া বাড়িতে। সুখেই সংসার যাপন করছিলেন। ক্রমে তাঁর ঘরে এল এক মেয়ে আর এক ছেলে। সবকিছুই মসৃণ পথে চলছিল। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হতেই শহরের এক নামকরা বোর্ডিং বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ছেলেমেয়ে দুজনেই পড়াশোনাতে খুবই ভাল। পরীক্ষায় ভালই ফল করে ক্রমেই বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু সংসারের তাল কাটল শরদিন্দুবাবুর স্ত্রী অসুস্থ হতেই। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনিমাদেবী মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলেন। শরদিন্দুবাবুর সুস্থির জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। ক্রমেই তিনি কেমন যেন কর্মবিমুখ হয়ে যেতে লাগলেন। সহকর্মীরা, আত্মীয়স্বজনেরা তাঁর এরকম ভাব দেখে পরামর্শ দিলেন দ্বিতীয়বার বিবাহের জন্য। শরদিন্দুবাবুও সন্তানদের কথা ভেবে রাজী হলেন বিবাহ করতে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে, যে সন্তানদের কথা ভেবে তিনি এই বিবাহে রাজী হলেন, তাদের জীবনেও নেমে আসতে চলেছে আরও বড় বিপর্যয়।

শরদিন্দুবাবুর নতুন স্ত্রী বিমলাদেবী একজন ধুরন্ধর মহিলা, তিনি বিবাহের পরই বুঝতে পেরেছিলেন যে শরদিন্দুবাবু তাঁর সন্তানদের খুব ভালোবাসেন। তাই তিনি শরদিন্দুবাবুর মন জিতে নিতে তাকে ভালোবাসার অভিনয়ে একদম অন্ধ করে দিতে চেষ্টা করলেন। ক্রমে ক্রমে তাদের জীবনেও এল আরও দুটি সন্তান। এক ছেলে আর এক মেয়ে। তারপর সংসার খরচের পরিমাণ ক্রমশঃ বাড়তে থাকায় বিমলাদেবী শরদিন্দুবাবুকে বাধ্য করলেন আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের বোর্ডিং স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে। অনিচ্ছা স্বত্বেও শরদিন্দুবাবু স্ত্রীর ক্রমাগত চাপে সেটাই করতে বাধ্য হলেন।

শরদিন্দুবাবু যেটা ভেবে ভয় পেয়েছিলেন সেটাই সত্য হল। বিমলাদেবী দিনরাত আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করলেন। তাদের পড়াশুনাও লাটে উঠল। হঠাৎ একদিন বিমলাদেবী শরদিন্দুবাবুকে জানালেন যে বড় মেয়ের জন্য একটি সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে সরকারী চাকরী করে। শরদিন্দুবাবু জানতেন যে তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো মূল্য থাকবে না। তাই এইপ্রকার বাধ্য হয়ে মেয়ের বিয়েতে রাজী হলেন। কয়েকমাসের মধ্যেই বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিমলাদেবী মনে মনে খুশি হলেন। ভাবলেন এবার ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিদিন দুপুরবেলা খাওয়ার সময় নিয়ম করে বড় ছেলেকে খাওয়ার খোঁটা দিতে লাগলেন। সেও বাধ্য হল এক কারখানায় কাজে ঢুকতে।

শরদিন্দুবাবু ছেলেমেয়েদের এই পরিণতি মেনে নিতে পারলেন না। সবসময় একটা অপরাধবোধ কাজ করত তাঁর মধ্যে। এরকমই একদিন অন্যমনস্ক হয়ে একটি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেললেন। হাঁটুর মালাইচাকী গেল ভেঙে। যেহুতু তিনি ডিউটিরত অবস্হায় দুর্ঘটনা ঘটেছিল তাই কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব দিলেন, আপনি রিটায়ারমেন্ট নিন, তার বদলে আপনার ছেলেকে চাকরী দেওয়া হবে।

কিন্তু বিমলাদেবী রাজী হলেন না নিজের ছেলেমেয়েদের স্বার্থে। ভাবলেন বড় ছেলে চাকরি পেলে যদি তাদের না দেখে। ফলে সেই সুযোগটাও হাতছাড়া হল। এত বিপর্যয় মেনে নিতে পারলেন না শরদিন্দুবাবু। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই একেবারে শয্যা নিলেন। কয়েকমাসের মধ্যেই তাঁর চাকরী থেকে তাঁকে অবসর নিতে হল।

বিমলাদেবীও এখন পড়লেন মহা বিপর্যয়ে। সংসার চালানো, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার খরচ, নিজের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কিভাবে সামলাবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু এটা বুঝতে পারলেন যে এই বিপর্যয়ে তার একমাত্র কান্ডারী হতে পারে তার বড় ছেলে, যার হতে যাওয়া চাকরী তিনিই হতে দেননি। সে বিপর্যয়েরও কারণও তো তিনি নিজেই ছিলেন ।

#banglasahitya


https://sahityashruti.quora.com/