মনোহরা - সুব্রত_মজুমদার

 

sahityapuran

মনোহরা

বাজারের পথে রোজই ডাকে বুড়োটা। ন্যুব্জ দেহ, ক্ষয়াটে চেহারা, একটা চোখ নষ্ট, ঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না । ছেলে বড় হয়ে লায়েক হয়েছে, মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সুখে সংসার করছে, বাপের মুখে একখাবল ভাত তুলে দেওয়ার সদিচ্ছা কারোরই নেই। অগত্যা কয়েকটা চকলেট, বিস্কুট নিয়ে বসে থাকে। যেটুকু ইনকাম হয় তাতে বুড়োর কায়ক্লেশে চলে যায়।

-“ও ভাইপো, যাচ্ছ কোথায় ? একটু দাঁড়াও। বাজার হতে ফিরতে একটু দেরি হলে বৌমা কিছু বলবে বুঝি ? কিছু বললে বলবে কাকা আটকেছিল।”

হেসে বললাম, “না কাকা, সেরকম কিছু নয়। কেমন আছেন আপনি ?”

-“আর থাকা, আঁটকুড়ি বৌ ছেলেটার মাথা খেয়েছে। খবর নেয় না। মেয়ে তবু ফোন করে। ভাবছি একমাস গিয়ে মেয়ের কাছে থাকব। রাঁচির আবহাওয়াও তো ভালো।”

বুড়োর মেয়ে রাঁচিতে থাকে। বহুবার বুড়োর মুখে রাঁচির মনোরম আবহাওয়ার কথা শুনেছি, কিন্তু যেতে দেখিনি কোনোদিন। তবে মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নেয় বাপের। ওটুকুই যা।

বয়াম হতে একটা চকলেট বের করে আমার হাতে দিল বুড়ো। আমি নিতে না চাইলে জোর করে ধরিয়ে দিয়ে বলল,”নাও নাও, চা-মিষ্টি খাওয়ানোর সামর্থ্য তোমার এই গরীব কাকার নেই। তাবলে অপমান কোরো না।”

গল্প করতে করতে সময়ের খেয়াল থাকত না। সম্বিত ফিরতে ফোনের আওয়াজে। গিন্নির ফোন। ধরলেই ওপার থেকে ত্রাণকর্ত্রীর গলা ভেসে আসত, “কি গো আজ আর ফিরবে না ?”

ফোন রেখে বলতাম, “আপনার বৌমা বারবার ফোন করছে কাকা। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার যাই। ”

একদিন কথা প্রসঙ্গে লোণের কথা উঠল। বুড়ো বলল, “তোমাদেরকে নরম পেয়ে পেয়ে বসে ওরা, কই বড় বড় লোকেরা যে লোণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে, তারবেলা ?”

বললাম, “কাকা, ওরা বড় বড় হনু, সে তুলনায় আমার লেজ অনেক ছোটো।”

বুড়ো হেসে বলল,”আমাকে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্ট হতে ঋণ নিয়ে আজও শোধ করিনি। যদি উদ্ধার করতে পারে তো আমার মরার পর। সারাজীবন বাবাকে দেখল না, মরার পর বাপের ঋণ নিয়ে তো ভুগুক। সে যাইহোক, আমার একটা কথা রাখবে ভাইপো ?”।

-“বলুন, চেষ্টা করব। ”

-“আমাকে মনোহরা খাওয়াতে পারবে ? কাঁদির মনোহরা। উহ্ কি স্বাদ তার। কতদিন আগে খেয়েছিলাম, মুখে লেগে আছে সেই স্বাদ। ছেলেকে তো বলে লাভ নেই, সে একমুঠো ভাতই দেয় না তো মনোহরার।”

মনোহরা নিয়ে গিয়েছিলাম মাসখানেক পরে। একদম কাঁদির মনোহরা। কিন্তু বুড়ো আর আমাকে ডাকল না। মনে মনে অসন্তুষ্ট হলাম। কাছে যেতেই বলল,”কে ?”

-“আমি কাকা, মাষ্টার। ”

-“ও ! কিছু মনে করো না ভাইপো, ডান চোখটাও গেছে। খুব কষ্ট…. ”

সেদিন অনেক কথাবার্তা হল। বারবার নিজের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা তুলে আক্ষেপ করতে লাগল । আমি শান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে কাকা, ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন আপনি, চিন্তা করবেন না। ”

এর ঠিক মাসখানেক পর বুড়োর ছেলে দিব্যেন্দু এল। পরনে কাছা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, – গুরুদশার বেশ। বলল, “বাবা আর নেই। কিছুই তো রেখে যেতে পারেননি, যথাশক্তি করছি।”

বললাম,”তোমার বাবা যা রেখে গিয়েছেন তা সবাই পারে না দিব্যেন্দু। উনি তোমাদের ভাইবোনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। উনি ছিলেন বলেই তুমি আজ এখানে।”

শ্রাদ্ধের দিন গেলাম। উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে শ্রাদ্ধের আয়োজন করা হয়েছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। দিব্যেন্দুর বৌ আমাকে নিয়ে গেল খাবার প্যান্ডেলে। এলাহি আয়োজন। শেষপাতে সন্দেশ রাজভোগের সাথে মনোহরা।

দিব্যেন্দুর বৌ বলল,”বাবা মনোহরা খেতে খুব ভালোবাসতেন। ”

মনোহরাখানা আর মুখে ওঠাতে পারলাম না, একটা বিচিত্র ঘৃণায় শরীরটা কেমন করে উঠল। খাবার ছেড়ে উঠে এলাম। দিব্যেন্দুর বৌ বিচলিত হয়ে বলল, “এ কি মিষ্টিগুলো খান, এখনও তো আইসক্রিম পান এগুলো বাকি।”

হনহন করে নেমে এলাম নিচে । দেখলাম পুরোহিত মশাই মন্ত্র পড়ছেন। আর সামনে ছবির ফ্রেম হতে উঁকি মারছে বুড়ো। মুখে হাসি। যেন যে দেশে গিয়েছে সেখানে মনোহরার কমতি নেই। কমতি আছে কৃতঘ্ন মানুষের, যাদের মনের মতো মন নেই।

#banglasahitya


https://sahityashruti.quora.com/