বয়ফ্রেন্ড - অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
বন্ধু মহলে পরীর খুব নাম ডাক । সাদা মাটা, সহজ সরল মেয়ে । বয়ফ্রেন্ড আর ছেলেবন্ধু কথা দুটো যে আলাদা সেটা কলেজে এসে প্ৰথম জানলো পরী । বয়ফ্রেন্ড নেই এরকম মেয়ের সংখ্যা পরীদের ক্লাসে হাতে গুনে বলা যাবে । অবশ্যই পরী তাদের একজন ।
বাড়িতে কড়া শাসন । পরীর বাবা প্রচন্ড রাগী মানুষ । ছেলে মেয়ের ওপেন মেলামেশা একদম পছন্দ করেন না । তার মতে এসব খারাপ । ভদ্র বাড়ির মেয়েরা অসভ্যের মত রাস্তায় ধিঙ্গিপনা করে না । সিনেমা দেখে দেখে ছেলে মেয়ে গুলো সব বিগড়ে গেলো ।
পরীর সব চেয়ে কাছের বন্ধু শ্রাবণী । শ্রাবনীর বাড়ি মানিকতলায় । সময় পেলেই চলে যেত শ্রাবণীদের বাড়িতে । শ্রাবনীর মা আদর করে খাওয়াতেন ।
হঠাৎ একদিন এসে উপস্থিত শ্রাবণীর মাসতুতো দাদা সায়ন্তন । যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে । ফাইনাল ইয়ার । পরীকে দেখে ফিদা । প্রথম দর্শনেই প্রেম । ছেলেদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার । মেয়েদের রূপ দেখে মজে যাওয়া । আলাপ -পরিচয় ,জানাশোনা , বোঝা -বুঝির কোন ব্যাপার নেই । দেহ সর্বস্ব প্রেম । মন সেখানে অনুপস্থিত । একবার ভেবেও দেখে না দুজনের মানসিক বন্ধুত্ব হবে কিনা ।
দুদিন বাদে সায়ন্তন ফোন করলো শ্রাবনীকে । কিছুটা অবান্তর কথা বলার পর আসল কথায় এলো । জানতে চায় পরী সম্পর্কে । পরী মেয়েটা কেমন ? বাড়ি কোথায় ? এইসব আর কি ।
শ্রাবণীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে সায়ন্তন মাঝে মাঝেই চলে আসে মাসির বাড়ি । উদ্দেশ্য একটাই । পরীর সাথে পরিচিত হওয়া । পরিচয় হল । বান্ধবীর দাদা । আলাপ করতে অসুবিধে কোথায় ? আলাপ হল । সায়ন্তনের কেন জানি না কেবলি মনে হচ্ছে যে আলাপ হলেও সেটা একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ । গন্ডির বাইরে বেরতেই হবে । তার জন্য চাই একটু সুযোগ । অযাচিত ভাবে এসে গেল সুযোগ ।
একদিন কলেজ থেকে ফিরতে আচমকা বৃষ্টিতে ভিজে ছিল সায়ন্তন । রাত্তিরে ধুম জ্বর । কলেজ যাওয়া বন্ধ । তিনটে দিন কোনমতে কাটালো। চতুর্থ দিন ফোন করলো শ্রাবণীকে । বলল তার অসুস্থতার কথা । যেভাবেই হোক পরীকে একবার তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেই হবে । সে অপেক্ষা করবে । না না করেও শেষ পর্যন্ত রাজি হল শ্রাবণী । নিয়ে এলো পরীকে । তিনজনে মিলে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা বাহানা করে উঠে গেল শ্রাবণী । ঘরে শুধু দুজন । সায়ন্তন আর পরী । বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কথা বলছিল সায়ন্তন । মাথার দিকে চেয়ারে বসে পরী । হঠাৎ পরীর একটা হাত ধরলো সায়ন্তন ।
বলল , আমি তোমায় ভালোবাসি । অসম্ভব ভালোবাসি । তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না । তোমার মত জানতে চাই । আজকে । এখনই ।
অপ্রস্তুত পরী । এই জাতীয় আচরণে সে প্রচন্ড ক্ষুব্দ । হাত ছাড়িয়ে নিল ।
বলল , এ সব কি বলছেন আপনি ? এভাবে ভালোবাসা হয় নাকি ?
তাহলে কিভাবে হয় ?
কথা নেই, বার্তা নেই দুদিনের দেখা আর তাতেই প্রেম । ভারী অদ্ভুত ছেলে তো আপনি । আমি চললাম । শ্রাবনীকে বলবেন আমি চলে গেছি ।
এক মিনিট দাঁড়াও । তুমি যা বললে সেটাই তোমার শেষ কথা ?
হ্যাঁ । আর কিছু বলবেন ?
এই দেখো । তোমার সামনে এই ব্লেড দিয়ে আমি আমার বা হাতের কব্জির শিরা কেটে ফেলছি । আমি লিখে রাখবো আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী ।
ভয় পেয়ে গেল পরী । বুঝে উঠতে পারছে না সে এখন কি বলবে । ভাবার সময় দিল না সায়ন্তন । ব্লেড চালিয়ে দিল । রক্তে ভেসে গেল হাত । টপ টপ করে রক্তের ফোটা পড়তে লাগলো মেঝেতে ।
আপনি পাগল নাকি ?
পাগল । বদ্ধ পাগল । শুধু তোমার জন্য । এখনো সময় আছে । মরার আগে জেনে যাই যে তুমি আমায় ভালোবাসো ।
জানি না ,যান ।
পরী বুঝতেই পারে নি সায়ন্তনের চালাকি । পরী যে তার প্রস্তাবে হ্যাঁ বলবে না সেটা সায়ন্তন জানতো । সেইজন্য চালাকির আশ্রয় নিয়েছিল । ধোঁকা খেল পরী । আলতাকে রক্ত ভেবে ভয় পেয়ে গেল ।
ঠিক সেই সময়ে খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো শ্রাবনী আর সায়ন্তনের মা । মেঝেতে রক্ত দেখে দুজনেই চিৎকার করে উঠলো ।
সায়ন্তনের মা বললেন , এখানে রক্ত এলো কিভাবে ?
পরী কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সায়ন্তন বলল ,
রক্ত নয় ,আলতা ।
তার মানে ?
ও তুমি বুঝবে না মা । পরে বলবো ।
সেই থেকে শুরু । প্রেমের ভেলায় ভাসতে লাগলো দুজনে । পরী আর সায়ন্তন । স্বপ্নের জাল বুনে যাওয়া । মাস থেকে বছর ঘুরে গেল । এর মধ্যে সুসংবাদ । চাকরি পেয়েছে সায়ন্তন । সুরাটে । চলে যেতে হবে পরীকে ছেড়ে । থাকবে কিভাবে বিরহী যক্ষের মত ? এখানে পরী ? সেওতো একা । তার তো দিন কাটবে না । রাত কাটবে না ।
সায়ন্তন চায় পরী চলুক তার সাথে । কিন্তু কোন পরিচয়ে যাবে সে ? বাড়ির লোক ছাড়বেই বা কেন ? পরীর বাবা জানলে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে । অথচ না বললেই নয় । দোটানায় পড়ে গেল পরী । সায়ন্তন বুদ্ধি দিল বাড়িতে কিছু বলার দরকার নেই । পরে জানালেই হবে ।
মাথা খারাপ নাকি ? পালিয়ে গেলে খোঁজ করবে না আমার ? থানা পুলিশ হবে ।
এর চেয়ে ভালো বাড়িতে জানানো । বাবা মায়ের মত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি । আমি বাড়িতে বলবো ।
অনেক সাহস নিয়ে পরী বলে ফেলল বাড়িতে । সবটা শুনে আর মেয়ের ইচ্ছা জেনে পরীর বাবা মা দুজনেই রাজি হলেন । তবে ছেলে এবং ছেলের বাড়ির লোকেদের সাথে আগে কথা বলতে চান তারা । খুব খুশি পরী । ফোন করে সায়ন্তন কে জানালো যে বাড়িতে মত দিয়েছে । আর কোন বাধা নেই । বিয়েটা করেই সায়ন্তন সুরাটে যেতে পারবে । সায়ন্তনের মত নেই । সে এখন বিয়ে করবে না ।
এখন বিয়ে না করার কারন জানতে চেয়েছিল পরী । এত তাড়াতাড়ি সংসারে জড়াতে চায় না সে । জীবনটা একটু উপভোগ করতে চায় । বিয়েতো পালিয়ে যাচ্ছে না । বরঞ্চ , পরী চলে আসুক সুরাটে । লিভ -ইন করবে দুজনে । দারুন মজা হবে ।
আর আমাদের বিয়ে ? জিজ্ঞেস করলো পরী ।
বাবু , বিয়েটা একটা সংস্কার মাত্র । কতকগুলো নিয়মে আর দায়িত্বে নিজেদের বেঁধে ফেলা । স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না । এই তো ভালো , জীবনকে উপভোগ করবো কিন্ত কেউ কারো দায় ভার বহন করবো না ।
তার মানে ? আমি চাকরি করি না । আমার কোন রোজগার নেই । আমাকে তো তোমার ওপরে নির্ভর করতে হবে । আমার ভরন-পোষনের দায়িত্ব কার ?
সে তো আমার । আমি বলছি বিয়ে না করে স্বাধীন ভাবে থাকা ।
অনেক ভাবলো পরী । একদিকে সায়ন্তন অপর দিকে তার বাবা মা । বিয়ে না করে একটা ছেলের সাথে লিভ -ইন করতে যাচ্ছে শুনলে তারা শুধু দুঃখ পাবে না , তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করবে । তারাতো বিয়েতে মত দিয়েছিল । যত ঝামেলা করলো সায়ন্তন । কিন্তু সায়ন্তন কে ছেড়ে থাকতে পারবে না সে । অসম্ভব ভালোবাসে সায়ন্তন কে ।
প্রেমের টানে শেষ পর্যন্ত ঘর ছাড়লো পরী । পালিয়ে গেল সুরাটে সায়ন্তনের সাথে । পালাবার সময় শুধু নিজের টুকু ভাবলো । লুকিয়ে নিয়ে গেল তার বিয়ের জন্য রাখা গয়নার বাক্স । অবশ্য সেটা গোপন রাখলো সায়ন্তনের কাছে । যেদিন তাদের বিয়ে হবে , সমস্ত গয়নাগুলো পরে সে নতুন বৌয়ের মত সাজবে ।
সংস্কার ভেঙে বয়ফ্রেন্ডের সাথে লিভ -ইন করার জন্য মনকে বোঝাতে হয়েছে পরীকে । ব্যাপারটা অত সহজ নয় । সবার মানসিকতা তো আর এক রকম হয় না । আজকাল অনেকেই লিভ-ইন করে । তাদের মনে হয় টাকার জোর আছে । অনেকেই আবার বয়ফ্রেন্ডের থেকে প্রচুর জিনিস বাগিয়ে নেয় । তারা অনেক বুদ্ধিমতী । নিজের জীবনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই হয়তো তারা বর্তমানকে গুছিয়ে নেয় । যার চাকরি আছে সে না হয় কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন । কিন্তু যার সেটাও নেই বিপদ তার সবচেয়ে বেশি । ভাবতে গেলেই কেন জানি পরীর রি রি করে উঠে শরীরটা । এখনো সে পুরো পুরি সংস্কার মুক্ত হতে পারে নি । যদিও পরী জানে যে তাদের বিয়ে হবে । সায়ন্তন খুব ভালো ছেলে । কখনোই তাকে কষ্ট দেবে না । তবুও বিয়ের আগে এক বিছানায় দিনের পর দিন ,রাতের পর রাত । মেয়েরা মনে হয় যাকে ভালোবাসে তাকে এই ভাবেই শরীর মন সব দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় ।পরী ভাবে সে ও তো নিঃস্ব হতে এসেছে । তার ভালোবাসা , তার রূপ , যৌবন সব উজাড় করে দেবে সায়ন্তন কে । তাইতো সে দিচ্ছে । তাকে পেয়ে সায়ন্তন খুশি । তবুও একটা কিন্তু পরীর গলায় ঝুলে আছে লকেটের মত । তার জানতে ইচ্ছে করে কী পরিচয়ে সে আছে এখানে ?
জিজ্ঞেস করেছিল সায়ন্তন কে, আমি কি পরিচয়ে এখানে আছি ?
কেন ,তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড । আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড । বয়ফ্রেন্ডের সাথে আছ তুমি ।
পরী মনে মনে ভাবলো আগেকার দিনে একেই বলত রক্ষিতা ।
মুখে বলল , আমরা কি কোনদিন বিয়ে করবো না ?
আবার সেই বোকা বোকা প্রশ্ন ? কেন, বিয়ে করলে অতিরিক্ত কি পাবে ? বরঞ্চ , এই তো দুজনে বেশ আছি । দুজনেই স্বাধীন । দুজনে জীবনকে ভোগ করছি নিজেদের মত ।
আমি না তুমি । তুমি ভোগ করছো । ভোগ করছো আমার শরীরটাকে । আমি অধিকার চাই । স্ত্রীর অধিকার । আমি মা হতে চাই ।
বিরক্ত হয় সায়ন্তন ।
বলে , দেখ পরী , তোমার এই সমস্ত সেন্টিমেন্টাল কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না । স্পষ্ট করে বলছি আমি এখন সন্তান চাই না । ওসব ঝামেলা আমার পোষায় না । যদি কখনো ইচ্ছে করে তাহলে ভেবে দেখবো । আসলে সারাদিন বাড়ি থাকো বলে তোমার মাথায় এইসব বাজে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । তোমার জন্য আমি একটা চাকরির ব্যবস্থা করছি । অফিসে পাঁচ জনের সাথে মিশলে মনটা ভালো লাগবে । তখন আর বাচ্চার চিন্তা মাথায় আসবে না ।
রাতে ঘুম আসে না পরীর । চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা । আবেগের বসে ভয়ঙ্কর ভুল করেছে সে । তার সাথে সায়ন্তনের আকাশ পাতাল পার্থক্য । সে ভেবেছিল এক । এখন বুঝতে পারছে সায়ন্তনের জালে আটকা পড়েছে । বাড়ি ফিরে যাবার মুখ নেই । কি করবে সে ?
সায়ন্তন অফিসে চলে গেলে সারাটা দিন সে একা বাড়িতে । দরজা বন্ধ করে ঘরেই থাকে । সময় কাটতে চায় না । আজকাল সায়ন্তন অনেক দেরি করে বাড়ি ফেরে । জিজ্ঞেস করলেই অসভ্যের মত চিৎকার করে । মাঝে মধ্যে ওর মুখে মদের গন্ধ পায় পরী । দিন দিন একটু একটু করে সায়ন্তন বদলে যাচ্ছে । কোথায় যেন ভালোবাসায় চিড় ধরেছে ।
সেদিন কি একটা কারনে সায়ন্তনের অফিস ছুটি । দুজনে গেছিল সোনার দোকানে । সায়ন্তন প্রমিস করেছিল একটা মঙ্গলসূত্র কিনে দেবে । দেয় নি । তার বদলে একটা সরু চেন কিনে দিয়েছিল । সেখানে কথা প্রসঙ্গে পরী জানতে পারে যে ওই দোকানের মালিক একজন মহিলা কর্মচারী খুঁজছে ।
পরের দিন সকালে সায়ন্তন অফিসে চলে গেলে পরী বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে । পৌঁছে গেল সেই সোনার দোকানে । চাকরির ব্যাপারটা নিয়েই কথা বলল দোকানের মালিকের সাথে । সব শর্ত মেনে নিল পরী । তার একটা চাকরির খুব প্রয়োজন । সকাল এগারটা থেকে রাত আটটা । সায়ন্তন যখন জানলো যে পরী কাজে যোগ দিয়েছে , সে খুব খুশি ।
বলল , এতদিনে একটা কাজের মত কাজ করেছ । আই লাইক ইট । বাই -দি বাই , আমি ক’দিনের জন্য মুম্বাই যাব অফিসের কাজে । দিন সাতেকের মধ্যে ফিরে আসবো । এই কটা দিন তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও ।
আর ফিরে আসে নি সায়ন্তন । কোনরকম যোগাযোগ রাখে নি । মোবাইলের সিম পাল্টে ফেলেছে । মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো পরীর ।
দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেল । কোন চিহ্ন নেই সায়ন্তনের । সংসার খরচের টাকা সব শেষ । চলবে কিভাবে ? ডুকরে কেঁদে উঠলো পরী । বুঝতে পারলো পাখি উড়ে গেছে । সায়ন্তন আর ফিরে আসবে না । এখন সে কোথায় যাবে ? কি করবে ? বাড়িয়ালা জানালো দু মাসের ভাড়া বাকি । এক সাথে এতগুলো টাকা কোথায় পাবে সে ? মাথায় কিছু আসছে না । নিজের গালে নিজেকে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে ।
এখন সব নতুন করে ভাবতে হবে । এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় দুটো চিন্তা । বাড়িয়ালার ভাড়া প্রথমেই মেটাতে হবে । এতটাকা ভাড়া দিয়ে এই বাড়িতে তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয় । অন্য কোন সস্তার বাড়ি খুঁজতে হবে । দ্বিতীয়ত , সে অন্তঃসত্বা । সায়ন্তন কে বলেছিল সে কথা । সায়ন্তন চেয়েছিল এবরশন করাতে । সে এবরশন করাবে না । এই নিয়ে দুজনের বেশ কিছুটা কথা কাটাকাটি হয়েছিল । পরে অবশ্য সায়ন্তন রাজি হয়ে যায় পরীর কথায় ।
বাড়ি ফেরার সমস্ত পথ সে বন্ধ করে এসেছে । তার সামনে দুটো পথ খোলা । এক মৃত্যু আর তা না হলে লড়াই করে বেঁচে থাকা । মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবি । তাকে অহেতুক ডেকে আনার কোন মানে হয় না । সে বাঁচবে । নিজের জন্য আর অনাগত সন্তানের জন্য । সে একলা মা হয়ে বাঁচবে । সিঙ্গল মাদার । অনেকেই আছেন । তবে তার সমস্যা একটু অন্য রকম । সন্তান বড় হয়ে জানতে চাইবে তার বাবা কে । সমাজ তার সন্তানের দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে , বাবা কে তোর ? বেজন্মা তুই । তার উত্তর সে কিভাবে দেবে তার সন্তান কে ? সমস্ত কিছুই তাকে আগে থেকে ভেবে রাখতে হবে । কোন অবস্থাতেই যেন তার সন্তান অন্যের উপহাসের পাত্র না হয় । এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে তাকে মানুষ করতে হবে তার সন্তানকে ।
এই মুহূর্তে বাড়িয়ালার ভাড়া মেটানো সব চেয়ে বড় সমস্যা । উঠে পড়লো পরী । হাতে কোন টাকা নেই । টাকা নেই বলতে ধার শোধ করার মত টাকা নেই । একমাত্র উপায় তার গয়নার বাক্স । মা কে না জানিয়ে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল । এখন তার নিজের গয়না বিক্রি করে বাড়ি ভাড়ার টাকা শোধ করতে হবে । সে জানেই না যে সায়ন্তন দুমাসের বাড়ি ভাড়ার টাকা বাকি ফেলে রেখেছে । কি শয়তান ! সমস্তই করেছে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক । তাকে অন্ধকারে রেখে ।
আলমারির ভেতরে লকার । লকারের ভেতরে বাক্সটা । বের করে রাখলো বিছানার ওপরে ।
এত হালকা কেন ?
বাক্স খুলতেই মাথায় হাত । একটাও গয়না নেই । সমস্ত গয়না নিয়ে পালিয়েছে সায়ন্তন । এত বড় চোর ! পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে পরীকে ।
তাহলে উপায়? একদম সর্বশান্ত সে । থাকার মধ্যে আছে হাতের দুটো বালা আর ওই সরু চেনটা । আবার কাঁদতে বসলো পরী । কান্না থামলে ভালো করে মুখ ধুয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে পড়লো । সামনেই অটো স্ট্যান্ড । চলে গেল নিজের কাজের জায়গায় মানে ওই সোনার দোকানে ।
দোকানের মালিক একজন গুজরাটি ভদ্রলোক ।
সরাসরি তার কাছে গিয়ে পরী বলল , আমি এই সোনার চেনটা বিক্রি করতে চাই । দেখুন তো কত টাকা পাবো ?
গলিয়ে দেখতে হবে কতটা সোনা আছে ।
হাতের একটা বালা খুলে দিয়ে পরী বলল, দেখুন তো এটা বিক্রি করলে কত পাওয়া যাবে ?
হাতে নিয়ে মালিক বললেন , এতো হলমার্ক দেওয়া । ভালোই টাকা পাবেন । একটা কথা বলি ?
বলুন ।
সব বেচে দিচ্ছেন কেন ?
টাকার দরকার । আর একটা কথা , আজকে আমি কাজে আসবো না । বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজন ।
কাজে না এলে তো শর্ত অনুযায়ী –
জানি । মাইনে থেকে টাকা কাটা যাবে । কেটে নেবেন ।
টাকাগুলো ব্যাগের ভেতরে রেখে বেরিয়ে গেল পরী । পরীর হাঁটা চলা এবং শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে একদিনেই যথেষ্ট পরিণত হয়ে গেছে । আর সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয় । শক্ত তাকে হতেই হবে । সামনে বিশাল লড়াই । মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে লড়বে কিভাবে ?
ভালো মানুষ পাশে থাকে । খারাপ মানুষ শিক্ষা দেয় । সায়ন্তন তাকে শিক্ষা দিয়ে গেছে । অনেক বড় শিক্ষা । নিজের পায়ে দাঁড়াবার শিক্ষা । পরী জানে পৃথিবীটা অত সহজ নয় । একা মেয়ের বাঁচতে চাওয়া পুরুষের কাছে স্পর্ধা । তার ওপর একলা মা । লোভী পুরুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে তাকে টেনে নামাতে । সমাজের কৌতূহলের শেষ নেই । হাত ধুয়ে নেমে পড়বে বাচ্চার বাবাকে খুঁজে বের করতে । যেন সমাজে আর কোন সমস্যা নেই । সব কিছু নিয়ম মেনে একদম ঠিক ঠাক চলছে । সমাজের ছন্দের তাল কেটে দিয়েছে একা পরী । তার এই একলা মা হওয়া অনেকদিন পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন স্তরে আলোচনার একমাত্র মুখরচক গল্প হয়ে থাকবে |
পরী ভেবে অবাক হয় এই মানুষগুলোর কি আর কোন কাজ নেই । আরে বাবা, সন্তান আমার । গর্ভে ধারণ করেছি আমি । মানুষ করবো আমি । আমি তো তোমাদের সাহায্য চাইছি না । তাহলে তোমাদের এত মাথা ব্যাথা কেন? তোমাদের সমস্যা কোথায় ? আমি মেয়ে বলে না আমার বিয়ে হয় নি বলে ? একলা মেয়ের মা হওয়া মানতে পারছো না । তাই বলে তোমাদের ভয়ে আমি হাল ছেড়ে দেব না । লড়াই আমি করব ।
বাড়ি ফিরে এসে পরী গেল বাড়িয়ালার কাছে । তার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিল । সাথে জানালো যে সে আর এখানে থাকবে না ।
বাড়িয়ালা জানতে চাইলেন , কেন মা ? কোন অসুবিধে হচ্ছে ?
না । এত টাকা দিয়ে আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয় ।
একটা কথা বলি মনে যদি কিছু না করেন ।
জানি আপনি কি বলবেন । আপনি সায়ন্তনের কথা জানতে চাইবেন । তাই তো ?
হ্যাঁ , না মানে
সায়ন্তন চলে গেছে । কোথায় গেছে জানি না তবে এখানে আর ফিরে আসবে না ।
তাহলে কি মা তুমি বেঙ্গলে ফিরে যাবে ?
না । এখানেই থাকবো । আমি একটা সোনার দোকানে কাজ করি । মাইনে যা পাই তাতে আপনার বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব নয় । অনেক সস্তার বাড়ি দরকার । তবে একটু ভদ্র পরিবেশে । আপনার সেরকম জানা শুনো আছে ? আপনি আমাকে মা বললেন । সেই অধিকারে একটা অনুরোধ করবো ?
কি অনুরোধ ?
দুটো দিন থাকতে দেবেন এখানে ? আমি এর মধ্যে একটা বাড়ি খুঁজে ঠিক চলে যাবো ।
বাড়িয়ালা ভদ্রলোক ব্যবসায়ী হলেও মানবিকতা হারান নি ।
বললেন , ঠিক আছে । আমি দেখছি তোমার জন্য একটা সস্তার বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।
পরী চলে এলো নিজের ঘরে । এখন তার অনেক কাজ । সমস্ত গোছগাছ করতে হবে । অবশ্য তেমন কোন জিনিস তার নেই । জামা কাপড় বাদ দিলে রান্নার জিনিস পত্র । সেগুলো লাগবে । কিন্তু নেবে কিসে ? গোটা দুয়েক বস্তা কিনে আনতে হবে । এমন সময় ডোর বেলটা বেজে উঠলো । বাড়িয়ালার স্ত্রী এসেছেন । এতদিন পরী এখানে থেকেছে কিন্তু খুব একটা আলাপ হয় নি ।
বললেন , শুনলাম তুমি চলে যাচ্ছ ।
হ্যাঁ ।
বাড়ি পেয়েছ ?
না । আংকেল কে বলেছি একটা দেখে দিতে । আমি তো এখানে কাউকে তেমন চিনি না ।
ঠিক আছে । যে কদিন নতুন বাসা না পাচ্ছ তুমি এখানেই থাকো । উনি বলেছেন তার জন্য টাকা লাগবে না । আর একটা কথা , এই কদিন আমার সাথে তুমি খাবে । লজ্জা করো না । তোমাকে কিছু রান্না করতে হবে না ।
কেঁদে ফেলল পরী ।
কাঁদছো কেন ?
মায়ের কথা মনে পড়লো । বাড়িতে মা ঠিক আপনার মত ।
আমি তো তোমার মায়ের মত । কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে ।
ঠিক আছে ।
খেতে খেতে পরী জানালো যে সে অন্তঃসত্বা । সে একাই থাকবে এবং নিজের পরিচয়ে ।
ভদ্র মহিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন পরীর মুখের দিকে । মেয়েটার সাহস আর মনের দৃঢ়তা দেখে অভিভূত । কিন্তু তিনিতো সংস্কারের বাইরে নন । মন থেকে মানতে পারলেন না পরীর একা একা মা হতে চাওয়া ।
বললেন , কত মাস ?
দু মাস ।
সময় আছে । নষ্ট করে দাও । অনেক ঝামেলা । তুমি একা পারবে না । এই সময় পাশে স্বামী ছাড়াও নিজের লোকজন প্রয়োজন । তুমি একা মেয়ে । পাঁচ রকম মানুষ পাঁচ রকম কথা বলবে । আমাদের দেশে এসব চলে না । আমি বলি তুমি তোমার মায়ের কাছে ফিরে যাও । তুমি দেখতে সুন্দর । তোমার বয়স কম । ওখানে গিয়ে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে সংসার কর । তখন বাচ্চার মা হও ।
চুপচাপ খেয়ে গেল পরী । কোন উত্তর দিল না । চলে এলো নিজের ঘরে । মন স্থির করে ফেলেছে সে । বাবা মার কাছে সে ফিরে যাবে না । তাদেরকে সে কোন লজ্জা জনক অবস্থায় ফেলতে চায় না । পরের দয়া আর নয় । সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে বাঁচবে । কোন ভাবেই পেটের বাচ্চাটাকে সে নষ্ট করবে না ।
পরের দিন সঠিক সময়ে কাজে গেল পরী । সোনার দোকানটা বেশ বড় । সব সময় ভিড় লেগেই আছে । দশ বারোজন কর্মচারী সব সময় শোরুমে থাকে । ওরা পাঁচজন মেয়ে বাকি সবাই পুরুষ । মালিক অথবা মালিকের ছেলে বসে থাকে গদিতে । কারিগরদের জন্য আলাদা বিল্ডিং । দুটো পল্ট আগে একটা ফ্ল্যাটের বেসমেন্টে । সেখানে বার দুয়েক যেতে হয়েছে পরীকে । মূলত পুরুষ কর্মচারীরা সেখানে যায় । বিষাক্ত গ্যাস আর ধোঁয়ায় ভর্তি ঘর । তিনফুট দূরত্বে এক একজন কারিগর বসে কাজ করে চেলেছে । সামনে ডেস্ক । ডেস্কের ওপর যন্ত্রপাতি আর একটা করে জ্বলন্ত প্রদীপ । প্রদীপের বুকে একতাল মোম । ডেস্কের ঠিক ওপরে ঝুলছে একটা করে বাল্ব । পেছন দিকটা মনে হয় ওয়াশরুম । দরজা খোলা । বিশ্রী গন্ধ । বমি এসে যাবার উপক্রম । কারিগররা নির্বিকার চিত্তে কাজ করে চলেছেন । সোনা পুড়িয়ে ,গলিয়ে ,পিটিয়ে গয়না তৈরী হচ্ছে । ঘরের এক কোনে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও । এফ এম এ গান চলছে । জনপ্রিয় হিন্দি ছবির গান ।
দোকানের সহকর্মীদের মধ্যে একজনের নাম লক্ষী । পরীর সাথে লক্ষ্মীর ভাব হয়েছে । মেয়েটি খুব ভালো । গুজরাটি কিন্তু হিন্দি জানে । গ্রাজুয়েট । বিবাহিতা । একটি ছেলে আছে । স্বামী ফিজিওথেরাপিস্ট ডাক্তার । এখানে সংসার চালাতে প্রচুর খরচ । দুজনে আয় না করলে খুব অসুবিধা । এডুকেশন খরচ অস্বাভাবিক । সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছে । যতদিন না হয় এখানে কাজ করবে । কিছু টাকা তো ঘরে ঢুকবে ।
আধ ঘন্টা টিফিন । লক্ষী আর পরী একসাথে টিফিন খায় আর গল্প করে । পরী ঘড়ি দেখলো পনেরো মিনিট হয়ে গেছে । আর দেরি করলো না । খুব সংক্ষেপে লক্ষীকে জানালো যে তার একটা বাড়ি ভাড়া চাই । সে একা থাকবে । বেশি ভাড়া হলে সে দিতে পারবে না । কিন্ত রেফারেন্স না হলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া মুশকিল । লক্ষী যদি একটু সাহায্য করে । এখন যে বাড়িতে আছে তার ভাড়া অনেক । পরীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় ।
লক্ষী একটু অবাক হল ।
বলল , প্রথম দিন সোনার চেন টা কিনতে তোমার সাথে যিনি ছিলেন উনি তোমার হাসবেন্ড তো ?
না । প্লিজ আর কিছু জিজ্ঞেস করো না । পরে একদিন বলবো । এই মুহূর্তে আমার একটা বাসা চাই । আমি একা মহিলা থাকবো । সিকিউরিটির ব্যাপারটা একটু দেখো ।
লক্ষী মেয়েটার কৌতূহল খুব কম । হেল্পফুল ।
বলল , একটা দিন আমাকে সময় দাও । হয়ে যাবে । আমার জানাশুনো এক জন বাড়ি ভাড়া দেয় । আমাদের দোকান থেকে বেশি দূরে না । আসা যাওয়ার অসুবিধে হবে না । তোমাকে কালকে আমি জানাবো ।
পরের দিন টিফিন বেলায় লক্ষী জানালো হয়ে যাবে । সে সব কথা বলে নিয়েছে ।
লক্ষী বলল ,আমি বলেছি আমার সাথে এক দোকানে কাজ করে একটি বাঙালি মেয়ে । একা থাকবে । বেশি ভাড়া দিতে পারবে না ।
পরী বলল ,বাড়ির মালিক মেনে নিল ?
মালিক না , মালকিন । আমার আত্মীয় । কোন অসুবিধা হবে না । ইচ্ছা করলে ওদের সাথে খেতে পারো । তার জন্য অবশ্য আলাদা টাকা লাগবে । তবে গুজরাটি খাবার তোমার ভালো লাগবে না । সবচেয়ে ভালো হয় যদি তুমি নিজে রান্না করে খেতে পারো । ঘরের সাথে কিচেন আছে । কিচেনটা বেশ বড় । ওয়ান রুম কিচেন । রান্না ঘরটায় সব সাজানো । ফ্রিজ আছে । একুয়া গার্ড , বাসনপত্র , আভেন , সব পাবে । ছোট গ্যাস সিলিন্ডার আছে । তোমাকে গ্যাস ভরে আনতে হবে । বাজারটা খুব বেশি দূরে না । ওখানে একটা গ্যাসের দোকান আছে । ওরা রিফিল করে দেয় । তবে একটাই অসুবিধা ঘরে এ সি নেই । গরমের সময় একটা কুলার ভাড়া করে নেবে । এখানে সব কিছু ভাড়া পাওয়া যায় । এরপরে কোন অসুবিধা হলে আমায় বলবে । মনে করবে আমি তোমার একটা দিদি ।
চোখে জল এসে গেছিল পরীর । কোনমতে সামলে নিল ।
মুখে বলল , তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব ?
লক্ষী বলল , কিছু বলতে হবে না । তুমি আমার ছোট বোনের মত । বাইরে থেকে এসেছ । একটা বিপদে পড়েছ । তাই পাশে এসে দাঁড়ালাম । হাতি ঘোড়া কিছুই করি নি তোমার জন্য ।
ঠিক দুদিনের মাথায় পুরনো বাসা ছেড়ে দিল পরী । উঠে এলো নতুন বাসায় । বাড়ির মালকিন সম্পর্কে লক্ষীর চাচী হয় । খুব ভালো মহিলা । স্বামী মারা যাওয়ার পর একাই আছেন । ছেলে বিদেশে । ব্যবসা করে । আগে আসতো । এখন আর আসতে পারে না । ওখানেই সংসার পেতে বসেছে । তবে মাসে মাসে টাকা পাঠায় । সেদিক থেকে কোন অসুবিধে নেই । এতবড় বাড়ি । একা একা থাকতে ভয় লাগে । সব সময় কাজের একটি মেয়ে আছে । চাচীর সাথে থাকে । এক সাথে খায় । ছোট ফ্যামিলি পেলে ভাড়া দিয়ে দেন ।
একজনের পক্ষে ঘরটা যথেষ্ট বড় । পরিষ্কার পরিছন্ন । নিজের মত ঘরটা সাজিয়ে নিল পরী । স্নান সেরে ছুটলো দোকানে । দেরী করলেই মালিক সবার সামনে যা তা বলবে । আজকে আর খাওয়া হয় নি । ঘরে কিছু নেই । খুব সকালে উঠে মাল পত্র নিয়ে চলে এসেছে । সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে তারপরে বাজার যাবে । সিলিন্ডারে গ্যাস ভরতে হবে । জিনিস পত্র কিনতে হবে । আজকে আর রান্না হবে না । পরের দিন থেকেই রান্না শুরু করবে । আজ যাহোক দোকান থেকে কিনে খাবে ।
অন্য দিন টিফিন বানিয়ে নিয়ে যায় । আজকে আর টিফিন নেই । ভেবেছিল দোকানের উল্টো দিকের স্টল থেকে চা বিস্কুট খেয়ে নেবে । টিফিনের সময় যথারীতি লক্ষী ডেকে নিয়ে গেল । সে দুটো বড় বড় টিফিন বক্স এনেছে ।
কাগজের প্লেটে সাজিয়ে দিল আলুর পরোটা , রাজমা , আচার আর হালুয়া । হা করে তাকিয়ে আছে পরী লক্ষীর মুখের দিকে ।
বলল , কী ব্যাপার ,আজকে বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান ছিল ?
না ।
তাহলে ?
তোমার জন্য করে এনেছি ।
আমার জন্য কেন ?
তুমি তো আজকে বাড়ি শিফট করেছ । রান্না করার সময় পাও নি । না খেয়ে এসেছ । আমার জন্য তো আনি । একটু বেশি করে আনলাম । দুজনের হয়ে যাবে । না , আর কথা নয় । চুপচাপ খেয়ে নাও । খেয়ে বল কেমন রান্না হয়েছে ।
এরপরে আর কিছু বলার থাকে না । গলার কাছে কান্নাটা আটকে রেখে মাথা নিচু করে খেতে লাগলো ।
লক্ষীর দিকে তাকিয়ে বলল , খুব সুন্দর হয়েছে । তোমার থেকে এই রান্না গুলো শিখে নেব ।
আমি খুব ভালো রান্না জানি । তোমাকে সব শিখিয়ে দেব ।
কিন্তু তুমি তো বললে যে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছ | পেয়ে গেলে চলে যাবে । তাহলে তোমার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে কিভাবে ?
ফোন তো আছেই । তাছাড়া তুমি আমার চাচীর বাড়িতে ভাড়া থাকো । আমার বাড়ি ও যথেষ্ট দূরে না । ছুটির দিনে দেখা করা কি খুব সমস্যা ?
না, তা না , । ঠিক আছে ।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো মাস কেটে গেল । বেবী বাম্প এখন নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে । ঢেকে রাখার আর কোন উপায় নেই । পরীর দিকে তাকালে আগেই চোখ পড়বে বেবী বাম্পের ওপরে । পড়ুক । সে তো আর লুকাচ্ছে না । লুকাবে কেন ? সে তো কোন অপরাধ করেনি । নিজের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছে । সন্তানের বাবা কে ? এই প্রশ্নটা তার কাছে অর্থহীন । সে নিজের ইচ্ছায় সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে । তার পরিচয়ে বড় হবে তার সন্তান । তার সমস্ত শরীরে নতুনের বার্তা । ডাক্তার দেখিয়েছে । অনেক নিয়মের কথা বলেছেন ডাক্তার । সব মেনে চলবে সে । তার সন্তানের জন্য সব রকম কষ্ট করতে সে রাজি । জীবনে এ এক অদ্ভুত আনন্দ । রোমাঞ্চকর । ভয় এবং সুখের মিশ্রণ । কেউ বুঝবে না । কাউকে বোঝানো যাবে না ।
লক্ষী জানে পরীর সন্তানের ব্যাপারে । পরী সব বলেছে তাকে । নিজের থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল লক্ষী । পরী বারণ করেছে ।
বলেছে , প্রয়োজনে অবশ্যই তাকে জানাবে । তবে এখন না ।
চাচীকেও বলেছে , দরকার পড়লে আপনাকে জানাবো । আপনি তো আছেন ।
প্রথমটায় চাচী একটু অবাক হয়েছিল । একা মেয়ের বাচ্চা হয় কোথা থেকে ? তাহলে এ কি সুবিধার মেয়ে নয় ? বাজারের মেয়েছেলে ? গা ঘিনঘিন করে ছিল তার । তারপর রাগ হল । প্রচন্ড রাগ । প্রথমে রাগটা গিয়ে পড়লো লক্ষীর ওপর । সব জেনেশুনে কেন সে একটা নোংরা মেয়েছেলেকে তার বাসা ভাড়া দিতে বলেছে ? পাঁচজন লোক যখন জানবে তখন তিনি কী বলবেন ?
লক্ষী চাচীকে বুঝিয়েছিল ।
বলেছিল , মেয়েটি খুব ভালো । ওকে বাড়ি থেকে ভুলিয়ে এখানে এনেছিল ওর বয়ফ্রেন্ড । সেই ছেলেটা এক নম্বরের শয়তান । পরীর জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে পালিয়েছে । অসম্ভব স্বাধীনচেতা মেয়ে । নিজের বাবা মা কে কোন রকম বিব্রত করতে চায় না । নিজের জন্য কারোর কাছে জবাব দিহি করতেও রাজি নয় । কারোর সাহায্য বা দয়া নিয়েও বাঁচতে চায় না । আমরা যদি ওকে একটু না দেখি একা মেয়ে কোথায় যাবে ? শেয়াল কুকুরে তো ছিঁড়ে খাবে । তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা চাচী । আমি সব জেনে বুঝেই তোমাকে বলছি ।
ভর্তি হয়ে গেল সরকারি হাসপাতালে । নার্সিংহোমে প্রচুর খরচ । সম্ভব নয় পরীর পক্ষে । যা হবার হাসপাতালেই হবে ।এর আগে সাত মাসের মাথায় একবার সমস্যা হয়েছিল । একটু একটু ব্লিডিং হচ্ছিল । সোজা চলে গেছিল হাসপাতালে । ডাক্তারবাবু চেক করে বলেছিলেন , বাচ্চাটা একটু নেমে এসেছে । একটা রাত্রি হাসপাতালে থাকতে হবে ।
পরী বলল , কিন্তু আমি তো জামা কাপড় কিছু আনি নি । ব্লিডিং হচ্ছে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম । তাই চলে এসেছি ।
এসে খুব ভালো করেছেন । বাড়িতে কাউকে জানিয়ে দিন । প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দিয়ে যাবে ।
লক্ষীকে ফোন করলো পরী ।
লক্ষী তখন দোকানে ব্যস্ত । সামনে কাস্টমার । মালিকের নজর বাঁচিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে । অন্য একজন কে বলে গেল কাস্টমারকে এটেন্ড করতে । ওয়াশরুমে গিয়ে সবটা শুনলো ।
বলল , তোমার বাড়িতে এখন যাওয়া সম্ভব নয় । আমার একটা সেট পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার হাসবেন্ড কে দিয়ে । পেস্ট , ব্রাশ ইত্যাদি সব কিনে দেবে ।বাড়ি ফিরে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করবো ।
পরের মাসটা কোন সমস্যা হয় নি । ডাক্তার যে ডেট দিয়েছেন তার আগের রাত্রে ভর্তি হয়ে গেল পরী । বাইরে থেকে যা যা করণীয় করলো লক্ষী আর তার স্বামী । তার পরের দিন সকাল আটটায় পরীকে নিয়ে গেল ওটিতে । নরমাল করানো গেল না । সিজার করতে হল । জ্ঞান ফিরতে অনেকটা সময় নিয়েছিল । বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল চাচী আর লক্ষীর স্বামী ।
বেশ অনেক্ষন বাদে বেডে দিয়েছে । পরী তখন ঘোরের মধ্যে । একজন সিস্টার পরীর দু গালে আলতো করে চড় মারতে মারতে ওর জ্ঞান ফেরাচ্ছিল । পরী তাকালো ।
চাচীকে দেখিয়ে সিস্টার জিজ্ঞেস করলো , ইনাকে চিনতে পারছেন ?
অস্পষ্ট একটা মুখ ভেসে উঠলো ।এবার চিনতে পারছে ।
বলল , চাচী ।
পরীর মাথায় চাচী হাত বুলিয়ে দিলেন ।
বললেন , তোমার মত দেখতে ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে । মেয়েকে কটে রেখেছে । তুমি এখন ঘুমাও । বিকেলে আমি আবার আসবো ।
একদিন পর থেকেই হাতে স্যালাইনের বোতল নিয়ে হাঁটা চলা শুরু করে দিয়েছে পরী । এমন কি ওয়াশ রুমে যাচ্ছে একা একা । সিস্টার ছুটে আসছে । ধমক দিচ্ছে । ডাক্তার জানতে পারলে তাদের আস্ত রাখবে না । পরীর তাতে কিছু যায় আসে না ।
তার পরিষ্কার কথা , কষ্ট আমাকে সহ্য করতেই হবে । সাত দিন পরে আমাকে কে দেখবে ? কে আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে ? সুতারং আমাকে আপনারা বাধা দেবেন না । আমার কিছু হবে না । একলা মায়ের অনেক ঝক্কি । অনেক শক্তপোক্ত হতে হয় তাকে । এতো সবে শুরু । এতো আতু আতু করলে আমার চলবে ? ওসব আমার জন্য নয় । আমাকে নিয়ে ভাববেন না । অন্যদের দেখুন । সব সামলে নেবো । বাচ্চাটাকে দিন । বুকে জড়িয়ে ধরি । এখন থেকেই ওকে শেখাবো ।
বলবো , তোর বাবা নেই । তুই একলা মায়ের সন্তান । তোর মা একা একাই তোকে মানুষ করবে ।
সমাপ্ত
#sahityashruti
Post a Comment