মেঘের দেশে (পর্ব- ৫) - সুমনা চক্রবর্তী
আপার পেদং এর বাজারটা খুব একটা জমজমাট নয়। একটা মার্কেটে যেমন দোকান থাকে ঠিক সেরকমই আছে। কিন্তু মানুষ এখানে বাজে ভিড় করে না। শুধু গাড়িগুলো যেখানে রাখা থাকে, সেখানে পর্যটকদের ভিড়। স্থানীয় লোকজন কিন্তু অযথা কাউকে বিরক্ত করে না। আবিরা আর মঙ্গল এখানেই গাড়ি রেখে তারপর হেঁটে কিছুটা ওপরে উঠবে বলে পা বাড়াল। সামনেই পেদং চার্চ এর শান্ত পরিবেশ আবিরাকে এক মোহময় জগতের মধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখল। চার্চের পাশেই বিশপ হাউস নিজের গরিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর পাহাড়ি সরু রাস্তা বেয়ে তারা আস্তে আস্তে আরও ওপরের দিকে উঠে গেল। আশেপাশে অনেক ছোট, বড় হোটেল, কটেজ পেরিয়ে তারা সোজা পৌঁছে গেল পেদঙ্গের একদম শিখরে, যেখানে কর্নেল অর্জুন তামাঙ্গের দোতলা বাড়িখানা রয়েছে। বাড়ির বাইরে বড় বড় অক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে রেখেছে আর্মির এই লোক। বাড়ির একতলায় রান্না আর খাওয়ার ব্যবস্থা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলে দোতলায় থাকার ঘর আর তিনতলায় ছাদ। পুরো ছাদ এসবেস্টস দিয়ে ঢাকা। এই ছাদে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর ডানদিকে পুরো পেদং ধরা পড়ে। বাড়ির একপাশে অনেক পুরনো বৌদ্ধ মন্দির আছে। মঙ্গলের কাছে আবিরা জানতে পারল, এই বাড়ির সামনে বাধানো জায়গা পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে ব্যবহৃত। দাহকাজ সুসম্পন্ন হলে অস্থি ভাসানো হয় অনেক নীচের নদীতে। আসলে বাড়িটা হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই স্থানে মানুষ নিজেদের অন্তিম কাজ করতে আসে। কর্নেল সেসব জেনেও কেন যে এই জায়গা অতিথি ভবন হিসেবে বাছলেন, সেটা আবিরার কাছে দুর্বোধ্য। গল্প শুনতে শুনতে সে নেমে এল নীচে। সেখানে হাসি মুখ করে বসে কর্নেল তার বাড়ির বর্ণনা শোনাচ্ছে এক বন্ধুকে। তার মুখে জপের মতো একটাই কথা – “ ডাইনিং রুম সে কাঞ্চনজঙ্ঘা দ্যাখা যায়”। আবিরা একবার ভেবেছিল সিকিমের বিমান চলাচল নিয়ে প্রশ্ন করবে, কিন্তু মঙ্গলের কড়া ধমক খেয়ে চুপ করে গেল। যে মানুষ ব্যবসার জন্য শ্মশানঘাটকেও ছাড়ে না, সে কখনোই আবিরার কথার সহজ উত্তর দেবে না। এখান থেকে চারপাশটা খুব সুন্দর দ্যাখায়। তা না হলে এর কাছে মঙ্গল আসত না।
আবিরা একটু রেগে গিয়ে বলল, “ তুমি যখন এসব জানতে, তখন এলে কেন”।
মঙ্গল হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ কভি কভি মউত কে পাশ ভি ভাগবান দিখাই দেতা হ্যায়। ইস জাগা তো জান্নাত হ্যায়। লোগো নে বহুত কউসিস করতে হ্যায় একবার ইয়াহা আনেকে লিয়ে। মাগার পারমিসান নেহি মিলতা। লেকিন জাহা ম্যায় হু, উয়াহা পারমিসান কেয়া?”
আবিরা হাসল। সে তো ভুলেই গিয়েছিল যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতার সাথে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গলাটা নরম করে বলল, “ সরি মঙ্গল, আমি ভুলে বলে ফেলেছি। সত্যি, তুমি না থাকলে আমার এই নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব হতো না”।
মঙ্গল পাহাড়ি রাস্তা ধাপ বেয়ে নামতে নামতে বলল, “ আপ কো মাফি মাংনি হ্যায় তো এক কাম কিজিয়ে। হামারে ফান্ড মে কুছ জমা কিজিয়ে”।
কথাটা শুনে কিছুক্ষনের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল আবিরা। এ আবার ছলনার কেমনতর উপায়? শেষে কলকাতার ব্যবসায়ীর মেয়ে শুনে টাকার কথা সরাসরি? আবিরা কোনও উত্তর দিল না।
নামতে নামতে পেদং স্কুলের কাছে দাঁড়াল মঙ্গল। ওদের বাস্কেটবল খেলার মাঠের কাছে গিয়ে বলল, “ এই প্লে গ্রাউন্ড কি আমার গাঁওয়ে হতে পারে না ? বাচ্চাদের বাবামায়েরা অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছে রুপায় কে লিয়ে। আগার উন কে পাস ভি ইসি তরহা এক স্কুল হোতা না, তব কোয়ই কাহি নেহি যাতা। ম্যায় কউসিস কার রাহা হু, বহুত জলদ উন কে ঘর মে ভি পঢ়াই কা সামান হগা। এক স্কুল, সারে বাচ্চে এক সাথ, এক গাঁও অউর এক ইউনিটি।
আবিরা যত মঙ্গলের কথা শুনছে ততই তার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। সে শুনেছে পাহাড়ি লোকেরা খুব সাহসী হয়। তাই সে নিজেও অনেক সাহস করে বলল, “ তুমি তো নেতা, তুমি পারো না এই স্কুল, বোর্ডিং এর ব্যবস্থা করতে?”
মঙ্গল মাথা নেড়ে বলল, “ লাস্ট মান্থ এ ডি এম এর সাথে দ্যাখা করেছি। উনি বলেছেন জমি দিতে পারলে স্কুলও হবে। আর উনিও হেল্প করবেন”।
আবিরা চোখ বড় করে বলল, “ কি বলছ? ডি এম সাহেব দ্যাখা করলেন?”
মঙ্গল হেসে বলল, “ ম্যাদামজি, এটা পাহাড়, আপনার কলকাতা নয়। এখানকার সব নিয়ম আমাদের মতো সাফ। যার যখন যেটা দরকার সে সেটার জন্য ডি এম সাহেবের সাথে দ্যাখা করতে পারে। বি ডি ও কে আমাদের কাছে কাজের হিসাব দিতে হয় ম্যাদামজি, বুঝলেন?”
আবিরার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “ তোমরা খুব ভালো বলেই এখানে এটা সম্ভব। কলকাতায় এটার আশা করা বৃথা। ওখানে আসলে সবাই সবার থেকে বড়, অনেক উঁচুতে থাকতে গিয়ে তোমাদের মত বাঁচতে ভুলে গেছে। আলোর নীচে এক গভীর অন্ধকারে আমরা ডুবে আছি”।
মঙ্গল আর কিছু বলল না। আবিরার কথা বোঝার ক্ষমতা ওর আছে। গাড়ি নীচে নামাতেই একটা জটলা মঙ্গলকে থামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে মঙ্গল নামতেই তার কাছে চলে এল পুলিশ। খাকি পোশাক ওর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ আরে ইয়ে তো চলতা ফিরতা আম্বুলান্স হ্যায়। গো উইথ হিম”।
মঙ্গলের কিছু করার ছিল না। বাচ্চা একটা ছেলের মাথা ফেটে গেছে। হাসপাতাল অনেক নীচে। কে আর ওদিকে যাবে এখন? মঙ্গলের গাড়িকে নামতে দেখে ওরা ভরসা পেয়েছে।
মঙ্গল কিছু বলার আগেই আবিরা দরজা খুলে দিল। ওরা সঙ্কোচের সাথে গাড়িতে উঠল।
মঙ্গল গাড়ি স্টার্ট দিয়েই কিছু বলতে যাচ্ছিল। আবিরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ দেখে চালাও মঙ্গল, গাড়িতে অসুস্থ একজন”।
আবিরা বাচ্চাটার হাত শক্ত করে ধরে থাকল। সে শুনেছে আঘাত পেলে একটু স্নেহের পরশ দিতে হয়। কষ্ট অনেক কম হয় তাতে।
সামনের আয়না দিয়ে মঙ্গলের চোখে সবকিছুই ধরা পড়ল। সে হাসল। কলকাতার সবাই তবে একরকম নয়।
#WestBengal
1 comment